নবম দফা : রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপের বিধান
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্যে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। অন্যসব অর্থনৈতিক বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার ও মূলনীতির আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার ব্যাহত হতে পারে এমন কোন অর্থনৈতিক নিয়ম বা নীতি কার্যকর করতে বা থাকতে দেওয়া কিছুতেই সঙ্গত হতে পারে না। এই উদ্দেশ্যেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রেকে অবশ্যই মারুফ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং মুনকার বা দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে সমস্ত উপায়ে সুবিচারমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরণের অর্থনৈতিক জুলুম ও শোষণের পথ বন্ধ করা।সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও জুলুমের অবসানের জন্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব আইন রচনা করতে পারে। এজন্যে প্রয়োজনীয় আইনগত ক্ষমতা আল্লাহ আল কুরাআনেই প্রদান করেছেন। ইসলামী সরকার আইন প্রয়োগ করে অবৈধ উপার্জণের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিতে পারে, পারে সব ধরনের অনাচারের উচ্ছেদ করতে। এই উপায়েই রাষ্ট্র সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরী, মজুতদারী, চোরাচালান,কালোবাজারী, পরদ্রব্য আত্মসাৎ সব ধরনের জুয়া, হারাম সামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলিত সব ধরনের অসাধুতা সমূলে উৎপাদন করতে পারে। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপেই মাধ্যমেই যাকাত আদায় ও বিলি-বন্টন, বায়তুল মালের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকা বা মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ইসলামী শ্রমনীতির রূপদান প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ সম্ভব।
রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন তাঁর সামনে কোন মডেল ছিল না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে মডেল তৈরীতে সাহায্য করলেন জীবরাঈল (আ) এর মাধ্যমে নির্দেশ পাঠিয়ে। সেই আলোকে তিনি গড়ে তুললেন নতুন এক সমাজ কাঠামো, অর্থনীতি ছিল যার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। তিনি ঠিক করে দিলেন অর্থনীতির কোন কোন রাষ্ট্রকে অবশ্যই নজরদারী করতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। আবার প্রয়োজন পূর্ণ সহযোগিতা নিয়েও এগিয়ে আসতে হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এমন কতগুলি বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম, কিন্তু তার লাগাম রাষ্ট্রের হাতে থাকাই বাঞ্চনীয়। যেমন উৎপাদন, বন্টন ও বিনিয়োগ। এগুলির যথাযথ তত্ত্বাধান না হলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, মুষ্টিমেয় লোকেই সকল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতির অন্ত রইবে না। মূলত : এই দৃষ্টিকোণ হতেই মানবতার অকৃতিম দরদী হযরত মুহাম্মাদ (সা) উৎপাদের পাশাপাশি তা থেকে গরীবদের হক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, ইয়াতীমদের যত্ন নিতে বলেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কৃষি জমি অনাবদী ফেলে রাখার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন।
আলোচ্য প্রসঙ্গে যে বিশেষ ক্ষেত্রেগুলিতে রাসূল (সা) হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তার কারণ ও ফলাফল পর্যালোচনা করা দরকার। সেগুলি হচ্ছে-
১। উপার্জন
২। কৃষি
৩। শিল্প ও শ্রমিক এবং
৪। ব্যবসা-বাণিজ্য
উপার্জন : ইসলামী রাষ্ট্র অবশ্যই ব্যক্তির উপার্জনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। উপার্জনের পথ ও পদ্ধতি হালাল বা বৈধ হতে হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সমস্ত সম্পদ ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কেননা সব অবৈধ পন্থাই হচ্ছে হারাম বা মুনকার এবং মুনকার নির্মূল করা ইসলামী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সরকার সুদ, ঘুষ, জুয়া,কালোবাজারী, মজুতদারী, চোরাকারবারী ইত্যাদি সকল হারাম উপায়ে উপার্জণের পথ রুদ্ধ করে দেবে। সরকার এজন্যে আইনের কঠোর ও ত্বরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অপরদিকে যদি অন্যের জমি, সম্পত্তি বা অর্থে কেউ জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে আত্মসাৎ করে থাকে তবে তা উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেবে। তা সম্ভব না হলে ঐ ধন-সম্পদ বায়তুলমালে জমা হবে। এমনকি কোন শাসনকর্তা বা সরকারী কর্মচারী পদের সুযোগ নিয়ে বিত্ত-সম্পত্তি করলে তাও সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। যদি এ কাজ না করা হয়, তবে সমাজে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার অব্যাহত থাকবে। পরিণামে তা রাষ্ট্র ও সমাজের অকল্যাণ ও মারাত্মক দুর্গতি ডেকে আনবে।
কৃষি : কৃষির স্বার্থে বর্গাচাষের শর্ত ও পদ্ধতির কারণে কৃসক যেন অত্যাচারিত না হয় সে বিষয়ে রাসূল (সা) সবিশেষ সতর্ক থাকতে বলেছেন। উপরন্তু জমি যেন অনাবাদী ও পতিত পড়ে না থাকে সে ব্যবস্থা করা সকরকারেই দায়িত্ব। জমির উৎপাদন ক্ষমতা, পরিমাণ ও গুনাগুনের ভিত্তিতে খারাজ জনগণের জন্যে দুর্বিষহ ভারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে সরকারকেই। কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে কৃষককে সাহায্য করা দরকার। কৃষিপণ্যের বাজার, মূল্য ও সরবরাহের উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে তেমনি কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সঙ্গত দাম হতে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া মূল্য বেড়ে গিয়ে জনগণের ও অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারের অপর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে মীরাস বা উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা। বিশেষত :ইয়াতীম ও স্ত্রীলোক এই বিধানের সুফল পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমানে সমাজে ন্যায্য প্রাপ্য হতে ওয়ারিশরা প্রায়ই বঞ্চিত হয়। সৎভাই-বোনেরা বিতাড়িত হয়। এর কারণ মীরাসী আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব। এ ব্যাপারে সরকারকে অবম্যই কঠোর হতে হবে। পক্ষপাতহীন শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দুর্নীতি দমনে করা সম্ভব। অসিয়ত ও ওয়াকফকৃত জমি যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকেই।
শ্রমিক : রাসূলের (সা) নির্দেশের প্রেক্ষিতে একথা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় যে ইসলামী সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় নিশ্চিত করা। তাদের উপর যাতে জুলুম না হতে পারে তার যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শ্রমিকদের মজুরী যেন তাদের জীবন-যাপনের জন্যে উপযুক্ত হয় তা দেখাও সরকারে দায়িত্ব। শ্রমিকদের জন্য সরকার একটা নিন্মতম মজুরী নির্ধারণ করে দেবে। শিল্পমালিকেরা এই মজুরী দিতে বাধ্য থাকবে। বাস্তবতার আলোকেই সরকার শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা দানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন করবে। শ্রমিকদের নায্য অধিকার সংরক্ষণ, বাসস্থান, চিকিৎসা, বোনাস ইত্যাদির সুবিধাও এই আইনে থাকবে। এসব আইনের উদ্দেশ্যে হবে শ্রমিকদের সত্যিকার স্বার্থ রক্ষা করা।
ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসায়ের সব অবৈধ ও অন্যায় পথ এবং প্রতারণামূলক কাজ নিষিদ্ধ করাই শুধু ইসলামী সরকারের দায়িত্ব নয় বরং তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও দেখা কর্তব্য। ইহতিকার অর্থাৎ অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ওজনে কারচুপিও তাই। এ সমস্তিই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। না হলে জনসাধারণ ক্রমাগত ঠকতে থাকবে। এর প্রতিবিধানের জন্যে হিসবাহ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়েছিল। এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় সমাজকে তথা মানব চরিত্রকে কত গভীলভাবে রাসূলে করীম (সা) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
রাসূলে কারীম (সা) মাঝে মাঝেই বাজার পরিদর্শনে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে দোকানদারদের কার্যক্রম লক্ষ্য করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাজার ব্যবস্থার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। পরবর্তীকালে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা) একাজ করতেন। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাজার যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে। মজুতদারী, মুনাফাখারী, ওজনে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি বাজারে অনুপ্রবেশের সুযোগ না পায়। পন্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর বিধি-নিষেধও সম্ভবপর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে। কারণ, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর বাধা-বিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করার জন্যে সরকারকে সুষ্ঠু ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
No comments:
Post a Comment