Thursday, June 9, 2011

রজব মাসের ফজিলত

নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার নিকট গণনার মাস ১২টি। এতে কম-বেশি করার ক্ষমতা কারো নেই। এই মাসগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারিত করা হয়েছে আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করার পর। (আল কুরআন : সুরা তওবা)।
মাহে রজব আরবী বর্ষের ৭ম মাস।  বায়হাকী শরীফে আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স.) যখন মাহে রজবের নব চন্দ্র দেখতেন, তখন তিনি বলতেন-আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজাবা ওয়াশাবানা ওয়া বাললিগনা শাহরি রামাজান।’ অর্থ হচ্ছে, হে আল্লাহ আমাদের প্রতি রজব ও শাবান মাসকে বরকতস্বরূপ দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। হাদীসে পাকে মাহে রজবের বহু ফজিলত ও আমলের কথা বর্ণিত আছে। তার মধ্যে এখানে কিছু বাণী তুলে ধরা হল।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রসূল (স.) বলেছেন, মাহে রজব আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মাস। যে ব্যক্তি মাহে রজবকে সম্মান প্রদর্শন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করবেন।
 রসুল (স.) বলেছেন, হে আমার সাথীগণ! জিব্রাইল (আ.) আমাকে মাহে রজবের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে বলেছেন, রজবের ইবাদত মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত কোন মুশরিকের ভাগ্যে হয় না।
রসূল (স.) বলেছেন, মাহে রজব আল্লাহর মাস। মাহে শাবান আমার মাস। আর মাহে রমজান আমার ও আমার উম্মতের মাস। একদা মহানবী (স.) কোন এক কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মনে করলেন কবরবাসীকে আযাব দেয়া হচ্ছে। মহানবী (স.) বললেন, সে যদি রজব মাসে একটি রোযাও রাখতো, তাহলে তাকে এত কষ্ট দেয়া হতো না।
মাহে রজবের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত একটি অধিক পুণ্যময় রাত। এই রাতটিকে আরবীতে লাইলাতুল মেরাজ বলা হয়। এ রাতের গুরুত্ব, তাত্পর্য, ফজিলত ও বরকত অনেক বেশি।
আল কোরআনের ১৫ পারা সুরা বনী ইসরাঈলে এ রাতের যে ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে তা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মেরাজ নামে বিশ্ব ইতিহাসে সুপরিচিত। এই রাতে প্রিয় নবী (স.) আল্লাহ তায়ালার আদেশক্রমে মক্কা শরীফ থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস-ঊর্ধ্বাকাশে, আরোহণ করে আল্লাহ তায়ালার অধ্যাদেশ প্রাপ্ত হন।
ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, মেরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালা মহানবী (স.) কে মহানেয়ামত দান করেন। ১। উম্মতের জন্য মেরাজস্বরূপ ৫ ওয়াক্ত নামাজ।
আর সুরা বণী ইসরাইলে ১৪টি অধ্যাদেশাবলী। মূলত রজব মাস হলো রমজানের প্রস্তুতির মাস। এই মাস হতেই রসূল (স.) রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। যার ফলে ইবাদত ও বন্দেগীও বেশি করতেন। সেজন্য তাঁর উম্মত হিসেবে আমাদেরও উচিত এখন থেকে হূদয় কন্দরে পবিত্র রমজানুল মোবারকের একটি আবহ তৈরি করা এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য ইবাদত বন্দেগীও বেশি বেশি করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন, আমীন।

মাওলানা আবুল হোসাইন পাটওয়ারী
ইত্তেফাক
বৃহস্পতি, ৯ জুন ২০১১, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮

কেয়ামতের ছোট ও বড় আলামত

কেয়ামত এর আরবী অন্য একটি শব্দ হলো আসসাআহ যার অর্থ হলো সমস্ত মাখলুকাতের জীবনের শেষ সময়। যখন জগতের সবকিছু ভেঙ্গে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। আসসাআহ-এর ব্যাপারে কুরআনুল করিম ও হাদিসে রাসূলে অনেকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে সূরা আরাফের ১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, আপনাকে জিজ্ঞেস করে কেয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? আপনি বলে দিন এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। তিনিই তো অনাবৃত করে দেখাবেন নির্ধারিত সময়ে।
কেয়ামতের প্রাথমিক আলামতসমূহ
 কেয়াতের ছোট ছোট আলামতগুলোর অন্যতম হলো-
১।        এমন কিছু ঘটনা ঘটবে যা পূর্বে কখনো ঘটেনি এবং ঘটার কোন ধারণাই ছিল না।
২।        অমুসলিমদের হাতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ সম্পদ আহরিত হবে।
৩।        মানুষ তার বাসস্থানকে শিল্প কারুকার্জ দিয়ে সুশোভিত করাকে গুরুত্ব দিবে।
৪।        জমিনের অংশসমূহ নিকটবর্তী হয়ে যাবে।
৫।        শিক্ষায় বিপ্লব ঘটে যাবে কিন্তু দ্বীনি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাবে।
৬।        মহিলারা অশ্লীলতায় ডুবে যাবে। মহিলাদের সৌন্দর্য চর্চা কেন্দ্রের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে।
৭।        মহিলারা পুরুষের আকৃতি ধারণ করবে আর পুরুষ মহিলার আকৃতি ধারণ করবে।
৮।        কিছু মুসলমান মদ পান করবে অন্য নামে।
৯।        মানুষের মধ্যে সুদের ব্যাপক বিস্তার হয়ে যাবে।
১০। অভিনন্দন ও অভিবাদন মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে যাবে।
১১। জমিনের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক বিধ্বংসী ভূমিকম্প সংঘটিত হবে।
১২।      হঠাত্ মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাবে আর হত্যা গুম বৃদ্ধি পাবে।
১৩। মানুষ কথায় সুন্দর হবে, আর কাজে অসুন্দর হবে।
১৪।      কন্যা সন্তানরা তার মায়ের শাসনে থাকবে এবং মায়ের অনুকরণীয় হবে।
১৫। বেপর্দা  ব্যক্তিরাই সমাজের নেতৃত্ব দিবে।
১৬। সমাজের নিকৃষ্ট এবং রাখাল শ্রেণীর লোকেরা সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করবে।
১৭।     জগতের লোকেরা সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণে একে অপরে প্রতিযোগিতা করবে।
১৮। মানুষ তার সন্তানের চাইতে কুকুর লালন পালনকে বেশি প্রাধান্য দিবে।
১৯। নারীরা চুলের খোপা মাথার ওপরে এমনভাবে বাঁধবে যেন উটের পিঠের উঁচু জায়গার মতো দেখাবে।
২০।     দুনিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা অতিদ্রুত ও সহজ হয়ে যাবে।
২১।      কাল বা সময় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে।
২২।     দাসী ও সমাজের নিকৃষ্ট মেয়েরা যে সন্তান জন্ম দেবে সে সমাজের অন্যতম নেতা হবে।
২৩।     অবৈধ জারজ সন্তানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ।
২৪। সমাজে সম্মানিত কুলীন ভদ্রলোকগুলো কোণঠাসা হয়ে যাবে আর নিকৃষ্ট অসম্মানী লোকগুলো বেপরোয়া সাহসী হবে।
২৫।  বড়কে সম্মান করবে না। ছোটকে স্নেহ করবে না।
২৬। সমাজে নেতা নেতৃত্ব বেড়ে যাবে বিশ্বস্ততা কমে যাবে।
২৭।     উলঙ্গ আর বেহায়াপনার প্রতিযোগিতায় নারীরা ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হবে।
২৮। জেনা ব্যাভিচার আর মদপান বেড়ে যাবে।
২৯। প্রকৃত আত্মীয়দের ছেড়ে বন্ধু-বান্ধবদের আতিথেয়তা বেড়ে যাবে।
৩০। সমাজে ফাসাদ দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
মুসলিম শরিফে বর্ণিত, হযরত হুযাইফ বিন উসাইদ আল গিফারি (রা.) বলেন, আমরা যখন কোন বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনায় রত ছিলাম তখন রাসুল (স.) আমাদের নিকট আগমন করলেন এবং বললেন তোমরা কি বিষয়ে আলোচনা করছো। তারা জবাবে বলল, আমরা কেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। রাসুল (স.) তখন বলেন, কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না এই আলামতগুলো দেখতে পাবে। সেগুলো হলো:(১) দুখান বা ধোয়ার উদগীরণ হবে ২) দাজ্জালের আবির্ভাব ৩) দাব্বাতু মিনাল আরদ ৪) পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া। ৫) ঈসা ইবনে মারইয়ামের অবতরণ ৬) ইয়াজুজ মাজুজের প্রকাশ ৭) পরপর তিনটি চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর পশ্চিম অংশে ও পূর্ব অংশে আর ৮) আরব উপদ্বীপে ৯) ইয়ামেনের ভূমি থেকে আগুন বের হবে। যা মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে একত্রিত করবে। ১০) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যের উদয় ও পূর্বদিকে অস্তগমন।
সংক্ষিপ্তাকারে কেয়ামতের বড় আলামতসমূহের আলোচনা:
১) দুখান-যার অর্থ ধোয়া বা ছাই- এই ধুয়া শেষ যুগে আসবে যা আবহাওয়াকে গভীরভাবে দূষিত করবে। যার প্রভাবে মুমিনগণ সর্দি ও কাশিতে ভুগবে। আর কাফেরগণ নেশাগ্রস্ত হয়ে তার নাক, কান ও পশ্চাদ দিয়ে বের হবে। এর প্রভাব ৪০ দিন-রাত পর্যন্ত স্থায়ী হবে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, অতএব আপনি সেই দিনের অপেক্ষা করুন যখন আকাশ ধুয়ায় ছেয়ে যাবে যা মানুষকে ঘিরে ফেলবে, এটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা দুখান আয়াত-১০-১১)। রাসুল (স.) দুখান সম্পর্কে বলেন, এটা হলো এমন এক ধুয়া যা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলবে যার স্থিতিকাল হবে ৪০ দিন-রাত।
(২) দাজ্জালের আবির্ভাবঃ- সহি বুখারি ও মুসলিম শরিফের বর্ণনায় তার প্রকার সময় স্থিতি ও শেষ সম্পর্কে বর্ণনা করে বলা হয়েছে। দাজ্জালের পরিচয় সম্পর্কে হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেন: দাজ্জালের চক্ষুসমূহ হবে টেঁরা দুই চোখের মাঝখানে আরবিতে কাফের লেখা থাকবে যা সকল শিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানগণ পড়তে পারবে। আর তার শরীর হবে মোটা তার কাছে আগুন থাকবে পানিরূপে আর পানি থাকবে আগুনরূপে। রাসুল (স.) তার প্রকাশের স্থান সম্পর্কে বলেন, মাসিহে দাজ্জাল বের হবে শাম ও ইরাকের মাঝখান থেকে। সে দুনিয়ায় অবস্থান করবে ৪০ দিন যার একদিন হবে এক বত্সরের সমান আরো একদিন হবে এক মাসের সমান, আরো একদিন হবে এক সপ্তাহের সমান, আর বাকি দিনগুলো হবে আমাদের দিনগুলোরই মতো। সে আল্লাহর জমিনে ফাসাদের প্রসারণ ঘটাবে এবং তাকে আল্লাহ এমন কিছু অলৌকিক শক্তি দেবেন যা দেখে কাফের, ফাসেক এবং মোনাফেকরা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। আর মুসলমানগণ ইমানের ওপর অটল থাকবে কেননা মুমেনগণ মুজেজা আর এই অলৌকিকতার মাঝে পার্থক্য করতে পারবে। দাজ্জালের শেষ সময়ে ঈসা ইবনে মারইয়াম প্রকাশ পাবে। তার একটি কাজ হবে এই দাজ্জালকে বাবে লুদে হত্যা করা। রাসূল (স.) সব সময় এই দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।
৩। দাব্বাতু মিনাল আরদঃ  এই দাব্বাতুল আরদ মানুষের মাঝে ফাসাদের সময় শেষ যুগে বের হবে। আল্লাহর আদেশ ছেড়ে সত্য দ্বীনকে পরিবর্তন করে দিবে। যার ব্যাপারে মানুষেরা বলাবলি শুরু করবে। হাদিসের ভাষায় তার শরীর হবে ৬০ গজ লম্বা, তার থাকবে চারটি পা, দুইটি ডানা ও পালক। এটি বের হবে মসজিদে হারামের নিকটবর্তী সাফা পাহাড়ের নিচ থেকে, যে আরবিতে কথা বলবে। এটি. তিনদিন বের হবে, মানুষ দেখবে কেউ বের হবে না।
৪। ঈসা ইবনে মারইয়ামের অবতরণ: হাদিস শরিফে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ কেয়ামতের আলামতের অন্যতম। ঈসা (আ.) পূর্ব দামেস্কের কেন্দ্রীয় মসজিদের মিনারে অবতীর্ণ হবেন। তিনি এসে কোন নুতন ধর্মের বা দাওয়াতের বা নবুয়তের দিকে ডাকবেন না বরং তিনি মুসলমানদের ইমামের পিছনে সময় মতো নামাজ পড়বেন। ক্রুশসমূহকে ভেঙ্গে ফেলবেন, এই কথার বাস্তবতায় যে, তিনি হত্যা বা ক্রুশবিদ্ধ হন নাই। বরং আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি শূকরকে হত্যা করবেন, মদ ফেলে দেবেন এগুলো হারাম হওয়ার কারণে। ঈসা (আ.) দাজ্জালকে খুঁজতে খুঁজতে বাবে লুদের নিকট পেয়ে তাকে হত্যা করবেন।
৫। ইয়াজুজ মাজুজের আত্মপ্রকাশ সর্বশেষ চেষ্টায় দুটি বাঁধকে দুর্বল করে ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে সক্ষম হবে এবং তারা দুনিয়াতে প্রচণ্ড রকমের ফ্যাসাদে ভরপুর করবে। দুনিয়ার সকল স্থানে ফাসাদের বিস্তৃতি ঘটাবে। তার পা হবে লম্বা, সাগর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সকল পানি শুষে নিবে।

মো.এনামুল হক
ইত্তেফাক
বৃহস্পতি, ৯ জুন ২০১১, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮
 চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এরাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ সোসাইটি, ঢাকা।