সপ্তম দফা : ওশরের প্রবর্তন ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইসলামীকরণ
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়নে পূর্ব পর্যন্ত আব ভূখন্ডে ভূমি রাজস্বের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। রাসূলে কারীম (সা) এই অবস্থার পরিবর্তন সাধন করেন। সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের জন্যে তিনি একটি নির্দিষ্ট হারে ওশর নির্ধারণ করেছিলেন। কৃষি কাজের উপযুক্ততার দিক থেকে জমির দুটি শ্রেণী রয়েছে-সেচবিহীন ও সেচযুক্ত। প্রথমোক্ত ভূমি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বৃষ্টির পানিতেই সিক্ত হয়। অন্যটিতে মানুষ কায়িক শ্রম, পশুশ্রম বা যন্ত্রের সাহায্যে জলসেচ করে কৃষি কাজের উপর উপযুক্ত করে নেয়। এই উভয় ধরনের জমির ওশরের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তা নিন্মরূপ-মুসলমানদের নিকট থেকে ওশর (এক-দশমাংশ) আদায় করবে। এই পরিমাণ ফসল ঐসব জমি হতে গ্রহণ করা হবে যা বৃষ্টি বা ঝর্ণার (স্বাভাবিক) পানিতে সিক্ত হয়। কিন্তু যেসব জমিতে স্বতন্ত্রভাবে পানি সেচ করতে হয় সেসব হতে এক-বিংশতি অংশ (নিসফে ওশর) আদায় করতে হবে।
তারীখ-ই-তাবারী, ফতুহুল বুলদান
এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হচ্ছে যে, প্রতিটি মুসলিম তার জমিতে বছরে যা কিছু উৎপন্ন হোক না কেন তা থেকে ওশর অর্থাৎ এক-দশমাংশ এবং ক্ষেত্র বিশেষ ওশরের অর্ধেক অর্থাৎ এক বিংশতি অংশ বায়তুল মালে জমা দেবে। অবশ্য নিসাব পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে তবেই ওশর আদায় করতে হবে। ওশরের কয়েকটি অনন্য বৈশীষ্ট্য রয়েছে নীচে সেগুলি উল্লেখ করা গেল।
প্রথমত:
ওশর কখনই এবং কোন অবস্থাতেই রহিত করা যাবে না। এর হারও চিরকালের জন্যে নির্দিষ্ট। এ থেকে কোন অবস্থাতেই কাউকে অব্যহতি দেওয়া যেতে পারে না। তবে কোন মৌসুমে কোন ফসল নিসাব পরিমাণের কম উৎপন্ন হলে তার ওশর আদায় করতে হবে না।
দ্বিতীয়ত:
ওশর আদায় করতে হবে প্রতিটি ফসল হতেই। অর্থাৎ যেসব জমিতে বছরে দুটি বা তিনটি ফসল হবে সেই ফসলের প্রত্যেকটি হতেই ওশর আদায় করতে হবে। এর ফলে বায়তুল মালের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, পরোক্ষভাবে জাতি ও দেশেরই খেদমত করা হবে।
তৃতীয়ত :
ওশর আদায় করতে হবে ফসলের দ্বারাই। এ ব্যবস্থা কৃষক বা ভূমি মালিকের জন্যে খুবই অনুকূল। কারণ, ফসল কমই হোক আর বেশীই হোক, তা থেকে নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করতে কৃষকের অসুবিধার সম্ভবনা নেই। তাছাড়া নগদ টাকা যদি ওশর দিতে হয় তাহলে কৃষকের অসুবিধা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফসলের দাম কখনই নির্দিষ্ট থাকে না। কোন বছর যদি বিশেষ কোন ফসল বেশী পরিমান উৎপন্ন হয় বা অন্য কোন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে মূল্য হ্রাস পায় তাহলে নির্দিষ্ট ওশর পরিশোধ করার জন্যে কৃষক অধিক পরিমাণে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে। এতে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নানা ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্তা চালু রয়েছে। ইউরোপ, বিশেষত: ইংল্যান্ডে এই সেদিনও ভূমিদাসদের দ্বারা জমি চাষ করানো হতো। সাধারণ রায়তদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকের বেশী জমিদার ও চার্চের নামে আদায় করা হতো। ভূমির মালিকানা মুষ্টিমেয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর পর শিল্প বিপ্লবের ফলে জমির উৎপাদন যখন বহুগুন বৃদ্ধি পায়, তখন বড় বড় শিল্পপতিরা হাজার হাজার একর জমি সস্তায় কিনে একই সঙ্গে ভূস্বামী হয়ে বসে। উপরন্ত নব্য জমিদাররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি হয় কিনে নেয় অথবা শক্তির দ্বারা চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। ফলে বেকার ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজতন্ত্রে ভূমিস্বত্ব নীতিতে জমির ব্যক্তি মালিকানা শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, বরং ব্যক্তিকে জমি হতে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সমস্ত জমি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানায় আনা হয়েছে। এজন্যে লক্ষ লক্ষ লোককে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। লেবার ক্যাম্প ও বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়েছে আরও বহু লক্ষকে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ভূস্বামীকে। তবেই জমি রাষ্ট্রয়ত্বকরণ করা সম্ভব হয়েছিল। উপরন্ত কৃষকদের এই রাষ্ট্রীয় ও যৌথ খামারে কাজ করতে গায়েব জোরে বাধ্য করা হয়েছে। বিনিময়ে অনেক সময় তাদের ভরণ-পোষণের উপযুক্ত ন্যূন্যতম পারিশ্রমিকও জোটেনি।
এই উভয় প্রকার ভূমিব্যবস্থাই বঞ্চনামূলক ও স্বভাববিরোধী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ ও জাতি বঞ্চিত ; সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মানুষ শুধু বঞ্চিত হয়, বরং শোষিত ও নিপীড়িত। এই অবস্থা যেন আদৌ সৃষ্টি না হয় সেজন্য চৌদ্দশত বছর পূর্বেই রাসূলে করীম (সা) এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিস্বত্ব নীতি ঘোষণা করেছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফত পর্যন্ত সে নীতি অনুসারে ভূমির বিলি-বন্টন ও মালিকানা নির্ধারিত হয়েছে।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূলুল্লাহ (সা) চূড়ান্ত ফায়সালা করে দিয়েছেন, জমি জায়গা সব কিছুই আল্লাহর। মানুষ তাঁরই দাস। অতএব যে ব্যক্তি অনাবাদী জমি চাষ উপযোগী ও উৎপাদনক্ষম করে তুলবে তার মালিকানা লাভে সেই-ই অগ্রাধিকার পাবে।
আবু দাউদ
ইসলাম ভূমিস্বত্ব নীতি অনুযায়ী জমির মালিকানা লাভ ও ভোগদখলের দৃষ্টিতে জমিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। সে গুলি হচ্ছে-
১। আবাদী ও মালিকানাধীন জমি। মালীকের বৈধ অনুমতি ব্যতীত এই জমি অপর কেউ ব্যবহার বা কোন অংশ দখল করতে পারবে না।
২। কারো মালিকানাভূক্ত হওয়া সত্বেও পতিত আবাদ অযোগ্য জমি। এই জমিতে বসবাস নেই, কৃষিকাজ হয় না, ফলমূলের চাষ হয় না। এই শ্রেণীর জমিও মালিকেরই অধিকারভুক্ত থাকবে।
৩। জনগণের সাধারণ কল্যাণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি। কবরস্থান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, স্কুল-কলেজ, চারণ ভূমি ইত্যাদি সর্বসাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট জমি এই শ্রেণীর আওতাভূক্ত।
৪। অনাবাদী ও পরিত্যক্ত জমি যার কোন মালিক নেই বা কেউ ভোগ-দখলও করছে না। এ ধরনের জমির বিলি-বন্টন সম্পর্কে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অনাবাদি, অনুর্বর, মালিকহীন ও উত্তরাধীকারহীন জমি-জায়গা এবং যে জমিতে কেউ চাষাবাদ ও ফসল ফলানোর কাজ করে না তা ইসলামী রাষ্ট্রের উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ব্যপারে সকল মুসলমানদের সাধারণ ও নির্বিশেষ অধিকার স্বীকার ও সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনই নীতি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
আবু ইউসুফ-কিতাবুল খারাজ
ইসলামে মাত্র একপ্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভূমি মালিকের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদার তালুকদার মানবদার প্রমুখ মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ইসলামে নেই। সে কারণে শোষণও নেই। উপরন্ত ওশর (ক্ষেত্রে বিশেষে ওশরের অর্ধেক) ও খারাজ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় জমির মালিক বা কৃষকদের উপর ইনসাফ ও ইহসান করা হয়েছে।
জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি, সে জমি রাষ্ট্রের হোক আর ব্যক্তিরই হোক। জমির মালিক যদি বৃদ্ধ পংশু শিশু বা স্ত্রীলোক হয় অথবা চাষাবাদ করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হয় তবে অন্যের দ্বারা জমি চাষ করাতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (সা) নির্দেশ হচ্ছে-
যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে, অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে হবে।
ইবনে মাজাহ
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
সেই জমি নিজেরা চাষ কর কিংবা অন্যদের চাষ করাও।
মুসলিম
উপরে বর্ণিত হাদীস দুটির আলোকেই হযরত উমর ফারুক (রা) হযরত বিলাল ইবনুল হারেস (রা) এর নিকট হতে রাসূলে করীম (সা) প্রদত্ত জমির যে পরিমাণ তাঁর চাষের সাধ্যাতীত ছিল তা ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মুসলিম কৃষকদের মধ্যে পুনর্বন্টন করে দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনবার জন্যে এক দিকে কিছু দেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ফসলের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে কোন কোন দেশে হাজার হাজার একর জমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ব খাদ্যের অনটন লেগেই রয়েছে। সুতরাং জমি যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা যাবে না তেমনি সমস্ত পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। ইসলামের দাবীই তাই। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পতিত জমি শুধু ব্যক্তিকে চাষ করতেই বলা হয় নি, উৎসাহ দেবার জন্যে ঐ জমিতে তার মালিকানাও স্বীকার করা হয়েছে। রাসূলে কারীম (সা) বলেছেন-
যে লোক পোড়ো ও অনাবাদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে।
আবু দাউদ
ইচ্ছাকৃতভাবে জমি অনাবাদী রাখার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। বরং জমি চাষের জন্যে এতদূর হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আবাদী জমি পর পর তিন বছর চাষ না করলে তা রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রই তা পুনরায় কৃষকদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেবে।
উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন হওয়া দরকার। এ জন্যে ইসলামের সেই প্রারম্ভিক যুগে বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামী ও শান্তির পথিকৃৎ হযরত মুহাম্মাদ (সা) যে ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তা আজও বিশ্বের শেষ্ট্র বিধান। মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কোন কিছু দিক দিকেই এর সমকক্ষ ও সমতূল্য কোন বিধানই আজকের পৃথিবীর নেই।
লেখক : শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান