খ্রীষ্ট ধর্মে নারীর অবস্থান যীশু নজরত শহর থেকে খ্রীষ্ট ধর্মের শিক্ষা শুরু করেন। খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দীতে এটি শুরু হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রুপ নেয় সেন্টপলের দিক নির্দশনায়। প্রাক-পলিন যুগে নারীর অবস্থা ভাল ছিল। আস্তে আস্তে খ্রীষ্টান ধর্মের তাত্বিক উন্নতির সাথে সাথে নারীদের জীবনে কঠোরতা ও শোচনীয অবস্থা হতে থাকে। সাধারণত কোন ধর্মের উদ্ভব হয় বিশেষ অলৌকিক ব্যক্তির মাধ্যমে। খ্রীষ্ট ধর্ম ও এর ব্যতিক্রম নয়। আর এ ধর্ম ঐ সমাজে প্রচলিত নিয়ম-নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে খ্রীষ্ট ধর্মের নারীর ব্যাপক পরিবর্তন হয়। একদিকে যেমন সাহসিকতার ফলে নারী ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন, আবার প্রথম নারী ইভ এর উত্তরাধিকারী হিসেবে আবার পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হযেছেন। নারীকে সকল পাপের কারণ বলে এদেরকে বলা হয় Women (woe to men)। খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে জেরুজালেমের পাদ্রীদের মধ্যে এক ধর্মীয় কাউন্সিলে নারীদের নিয়ে এক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল-নারীদের আত্মা আছে কিনা এবং তারা মানব জাতির অর্ন্তভূক্ত কি না? এতে অনেকে রায় পেশ করেছিল যে, নারীর প্রাণ থাকলেও আত্মা নেই। তাই সে মানুষ নয়। আবার কেউ বলেন- নারীকে যদিও মানব সীমার বাইরে ফেলা যায় না, তবুও সে সকল দোষের কারণ। আবার প্রাচীন ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্ব বেশী পরিলক্ষিত হয়। ফলে সার্বিকভাবে খ্রীষ্ট ধর্মের নারীর অবস্থা বর্ণনা করা কঠিন। নারীর অধিকার সম্পর্কেও খ্রীষ্ট ধর্মে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। কেউ বলে খ্রীষ্ট ধর্মে নারীর সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। আবার কেউ বলেন- দেয়া হয়নি। যাই হোক খ্রীষ্ট সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। বেশি ভাগ সমাজ তাদেরকে শয়তান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য তৎকালীন নারীদের প্রতি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলে অনুমান করা হয়। এরপর নারীদের সুসংবাদ দেওয়া হয়। বাইবেলে নতুন মঙ্গল সমাচারে নারীদেরকে সকর মুক্তির মূল বলে আখ্যায়িত করা হয়। খ্রীষ্টান নারীবাদী লেখক আর্থার বলেন- খ্রীষ্টান নারীদের চরম উপেক্ষা ও অবহেলার ফলে দিনে দিনে তা এমন ঘটনায মোড় নিতে থাকে যে, তৎকালীন খ্রীষ্টান সমাজের নারীর অবস্থান ছিল এরুপ: * ইতিহাসে নারীরা মূলত সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। * নারীদেরকে চার্চের নেতাগণ তাদের মতো করে উপস্থাপন করতেন। * নারীদের কে উপস্থাপন করা হয় পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। * নারীরা সাধারণত খারাপ বলে চিহ্নিত, তবে কিছু নারীকে ভাল বলে ব্যাখ্যা করা হয। * চার্চের লিপিবদ্ধ ইতিহাসে নারীর ইতিহাসে খারাপ বলে উল্লেখ করা হয়। খ্রীষ্টান ধর্মের গোড়াপন্থি পাদ্রীদের মনগড়া বিধান নারীদের জীবন পর্যদুস্থ করে তোলে। এক সময় খ্রীষ্ট সমাজে শান্তির দূত হিসাবে পৃথিবীতে আসেন লুথার ও ক্যালভিন। এ দুই মহান সংস্কারকের ফলে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রোটেস্টান ও ক্যাথলিক এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায। আকস্মিকভাগে বিভক্ত এ ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। তাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রের ধারনার ও মূল্যবোধের সীমা নির্ধারণ করে পূন:নির্ধারণ করা হয়। পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত এ সীমায় পরিবার বিশেষত নারীদের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধিত করে ভিন্ন মাত্রায়। লুথার এবং ক্যালভিন মনে করেন- নারীরা পুরুষের অধিনস্থ সৃস্টিকর্তার আদেশ-নির্দেশের ফলে। তবে তারা আধ্যাত্মিক দিক থেকে পুরুষের সমান। নারী-পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের প্রতিকৃতিতে সৃষ্টি নারী-পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের প্রতিকৃতিতে তৈরি বলে উভয়ই ঈশ্বরকে জানতে ও ভালবাসতে পারে। নর-নারীর মানব মর্যাদা একই। নারীর মর্যাদার ক্ষেত্রে প্রৈরিতিক পত্রে পোপ ২য় জন পল লিখেছেন-“সৃষ্টির বর্ণনার এই অংশের মধ্যে একটি নৃতাত্বিক সত্য নিহিত আছে: সমস্ত দৃশ্যমান সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হল শ্রেষ্ঠ মানব জাতি। সৃষ্টির সময়ই নর-নারী হিসাবে তাদের আহ্বান ও প্রকৃতি লাভ করেছে। আর তারা সকল সৃষ্টির উপরে স্থান পেয়েছে। নর-নারী হিসাবে তারা উভয়ই সমান মর্যাদা লাভ করেছে। তারা উভয়ই ঈশ্বরের প্রতিকৃতিতে সৃষ্টি” (২য় জন পল নারীর মর্যাদা-৬)। নারী যেমন পুরুষকে সেবা করবে তেমনি পুরষের উচিৎ নারীদের সেবা ও সাহায্য করা এবং পূর্ণতা দান করা। নারী ও পুরুষের মিলন মূলত ঈশ্বরের নিজেরই মিলন। ঈশ্বর নিজেই এ মিলনের উৎস ও লক্ষ্য। নারীর দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য খ্রীষ্ট ধর্মে নারীকে উপস্থাপন করা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। বস্তুত নারীর মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। খ্রীষ্ট ধর্মের গোড়াপন্থিদের দৃষ্টিভঙ্গি নারীরা সকল পাপের মূল। তারা ইভের উত্তরসুরী হিসাবে আদি পাপের কারণ। আবার খ্রীষ্ট ধর্মের উদারপন্থী প্রোটেষ্টান ও বর্তমানে সার্বিক খ্রীষ্টানদের সার্বজনীন মতবাদ- মাতা মারীয়াই সকল পাপের পরিত্রাণকারী যিশুর জন্মদাত্রী। সে হিসাবে নারীই সকল পাপের পরিত্রাণকারী। প্রথম নারী ইভ অনেক খ্রীষ্টান ইভকে দেখেন পাপের উৎস হিসেবে। সে কারণে নারী জাতী সকলেই পাপের অংশীদার। আদিপুস্তকে অর্থাৎ পুরাতন বাইবেলে এ মানব সৃষ্টি ও পতনের মূলে নারীকেই দায়ী করা হয়। সেখানে বলা হয় ইভই প্রথম শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফল খায় এবং আদমকে খাওয়ায়। এভাবেই পৃথিবীর প্রথম পাপের উৎপত্তি ও মানব জাতীর পতন হয় (আদি: ৩:১-৭)। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারনা, কারণ আদম সেচ্ছায় নিষিদ্ধ ফল খায়। তাই প্রথম ভাগিদার নর-নারী উভয়। পরিত্রাণকারী মাতা মারীয়া যে নারীর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রথম পাপ প্রবেশ করেছিল সেই নারীর মাধ্যমেই মানুষের পরিত্রাণের প্রথম ভবিষ্যত বাণী করা হয়েছিল।” আমি তোমার ও নারীর জাতীর মধ্যে এক শত্রুতা গড়ে তুলব, শত্রুতা গড়ে তুলব তোমার বংশ ও নারীর বংশের মধ্যে; সে তোমার মস্তক চুম্বন করবে, আর তুমি তার পদ দংশন করবে”(আদি: ৩:১৫) পরিত্রাণের ইতিহাসে ইভ এবং মারীয়া উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। উভয়ই নারী এবং দুটি স্বরুপ। একজনের মধ্য দিয়ে পাপ যেমন পৃথিবীতে প্রবেশ করেছিল, তেমনি অন্যজনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দয়া ও ক্ষমা এ পৃথিবীতে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ সৃষ্টির সময় ঈশ্বর নারীর মধ্য যে আদিরুপ দিয়েছিলেন, আদিপাপের দ্বারা ইভ তা হারিয়ে ফেলে। পূনরায সে আদিরুপ মারীয়ার মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মারীয়াই হচ্ছে নতুন ইভ তার মধ্য দিয়ে মানব পরিত্রাণ কার্য সূচিত হয়েছিল। নারীর মধ্যে যেমন ইভ আছে তেমনি মারীয়াও আছে। নারীর মধ্যে শুধু ইভকে দেখা যুক্তিযুক্ত নয়। যদি আমরা নারীর মধ্যে মারীয়াকে দেখতে ব্যর্থ হই তবে তা হবে মানব ইতিহাসে বিশেষত নারীর প্রতি অন্যায় অবিচার। মঙ্গল সমাচারে নারী খ্রীষ্ট ধর্মে নারীরে মর্যাদা অনুধাবন করা যায় নতুন নিয়মে বিভিন্ন মঙ্গল সমাচারে তাদের বর্ণনায়। নজরতে যিশু সঙ্গে অনেক নারীরই সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার জীবদ্দশায় খ্রীষ্ট নারীর মর্যাদা উন্নতি করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। মঙ্গল সমাচারে বর্ণীত নারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন মারীয়া। যিশুর মা মারীয়া যিনি কুমারী ও যোসেফের জগদত্তাবধু। স্বর্গদূত তার কাদে এসে বললেন: প্রনাম তোমায়! পরম আশিস ধন্য তুমি। প্রভু তোমায় সাথে আছেন। তুমি গর্ভধারন করে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেবে যার নাম রাখবে যিশু। যিশু প্রকৃত ঈশ্বর ও বিবি মারীয়া যিশুকে জন্ম দিয়ে হলেন ঈশ্বরের জননী। কুমারী হলেন মুক্তিদাতার জননী। ভূষিত হলেন মার্তৃত্বেও মহিমায়। সামাজিক জীবনে নারী সমাজ জীবনে নারীরা শুধু ভোগের সামগ্রী নয়। নারী হচ্ছে মা, কন্যা, বোন, স্ত্রী ও পরম আত্মীয়। তারা ভালবাসার উৎস। কোমলতা ও বাৎসল্যের প্রতীক। সমাজে তারা যথাযথ মর্যাদার অধিকারী। বিবাহ ও পরিবারে নারীদের স্থান ও মর্যাদা সমুন্নত করতে যিশু পূর্ববর্তী মোসীয় বিধানের নতুন ও সঠিক ব্যাখ্যা সবার কাছে তুলে ধরেন-“আপনাদের হৃদয় পাষাণ ছিল বলেই মোসী সেদিন স্ত্রীকে ত্যাগ করার অনুমতি আপনাদের দিয়ে গেছেন। আদিতে কিন্তু এমনটি ছিল না”। (মথি: ২৯:৮) যিশু পিতরের শ্বাশুড়ীসহ অনেক অসুস্থ নারীকে সুস্থতা দান করেছেন। অসুস্থ স্ত্রীলোকটি যিশুর পোশাক স্পর্শ করেই সুস্থ হয়েছেন। (মার্ক:৫:২৭) যিশু জাইরুসের কন্যাকে পুনরায় জীবিত করে তুলেছিলেন- “খুকী,আমি তোমাকে বলছি, উঠ”। (মার্ক:৫:৪১) যিশুর উপমা কাহিনীতে স্ত্রীলোকদের কথা উল্লেখ আছে। যিশু স্ত্রীলোকদের সম্বোধন করেন-“আব্রাহামের কন্যা বলে”। (লুক:১৩:১৬) যারা ব্যভিচারী ও পাপীষ্ঠা বলে ঘৃণীত ছিল যিশু তাদের প্রতিও সদয় আচারণ করেছেন। যিশুর মঙ্গল সমাচারের উপমাতে বিধাব নারীও উপস্থিত। নারীর মর্যাদা ও গুরুত্ব যিশুর কাছে এতই বেশি ছিল যে, যিশুর অন্তীম মুহূর্তেও তার ক্রশের তলায় ছিল নারীগণ। এমনকি তাকে সমাহিত করে নারীরাই। আবার তার পূনরুত্থানের সাক্ষী সেই নারীরাই। বর্তমানে প্রৈরিতিক সেবা কাজ ও মিশনারী কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ এখন সেকথারই যথেষ্ট প্রমাণ। নারীর মাতৃত্ব মাতৃত্ব হল বিবাহে নারী ও পুরুষের মিলনের অবসম্ভাবী ফল। শাস্ত্রে বলা হয়-“তারা দুজন একই হবে”। (আদি:২:২৪) বিবাহ ইংরেজী Marriage যা ল্যাটিন শব্দ Matrimony থেকে এসেছে। যার অর্থ মা বিষয়ক। আর বিবাহে সন্তান জন্মদানের ভূমিকা বাবার চেয়ে মায়ের ভূমিকা বেশি। একজন নারী ছাড়া একটি নতুন জীবনের জন্ম ও লালন-পালন সম্ভব নয়। ঈশ্বর নারীকে মাতৃত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর মাতৃত্ব নারীর দায়িত্বও বটে। নারীর কুমারীত্ব খ্রীষ্টের শিক্ষায় নারীর মাতৃত্ব আর কুমারীত্বের লাভের সম্পর্কযুক্ত। কুমারীর কৌমর্য মাতৃত্বের মতই ঈশ্বরের দান। কৌমর্য লালন শুধু বিয়ে করে থাকা নয় বরং কৌমর্য স্বর্গরাজ্যের জন্য একটি জীবন-যাপন পদ্ধতি। কুমারী নারী ঈশ্বরকে তথা খ্রীষ্টকে তার ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করে। তাকে ভালবাসে ও সেবা করে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি নারীত্ব ঈশ্বরের পরিকল্পনা ও দান। যা মানব জাতীর জন্য ঈশ্বরের একটি অনন্য সাধারণ উপহার। সামাজিক প্রকৃতি দৈহিক গঠন ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতি সব কিছুই ঈশ্বরের পরিকল্পনা। নারী ঈশ্বরেরই প্রতিমূর্তি আর মর্যাদার দিক থেকে পুরুষের সমান। দূর্ভাগ্যবশত: পরিবেশের দ্বারা শর্তাবদ্ধ করে রাখে, যা নারীর প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তাদের মর্যাদা অস্বীকার করা হয়েছে এবং অধিকার সমূহের ভূল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে মঙ্গল সমাচারে নারীর মর্যাদা অত্যন্ত উন্নত। নারীর প্রকৃত মানবীয় মর্যাদার বিষয় সর্বদাই সচেতন এবং নিরলসভাবে মন্ডলী শিক্ষা দিয়ে থাকে। লেখকঃ ৪র্থ বর্ষ, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় E-mail : omarwrdu@gmail.com | |
http://www.sonarbangladesh.com/articles/MdOmarFaruk |
Saturday, June 11, 2011
খ্রীষ্ট ধর্মে নারীর মর্যাদা ও অবস্থান
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment